অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে সাদরে গ্রহণ করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নিপীড়িতদের জন্য ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র একটি আশ্রয় ভুমি। যুক্তরাষ্ট্রের চরম অর্থনৈতিক সংকট চলাকালীন সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন আব্রাহাম লিংকন। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা যখন আক্ষরিক অর্থে আমেরিকাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল , ঠিক সেই সময় আব্রাহাম লিংকন অভিবাসীদের পূর্ণ জোয়ারকে চিহ্নিত করেছেন প্রকৃতির এক আশীর্বাদ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জাতীয় সংকট লিংকনের যুগের মতো অতোটা গভীর নয়। তবে মানুষ সমভাবে সৃষ্ট বলে যুক্তরাষ্ট্র সহজাতভাবে যে ধারণাকে যুগ যুগ ধরে লালন করছে তা বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বর্তমানে অভিবাসন বিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন একাধিক নতুন নীতিমালা নিয়ে এসেছে । নতুন নতুন অভিবাসন নীতিমালার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত নথি বিহীন অভিবাসী সহ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্প অভিবাসী প্রশ্নে তার পুরনো কঠোর অবস্থানকে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত নতুন নিয়ম অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিষেবা সদস্য এবং বিদেশে কর্মরত সরকারী কর্মচারীবৃন্দের সন্তানদের সরাসরি আমেরিকার নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যবস্থা জটিল করা হয়েছে। আমেরিকান সিটিজেনশিপ ও ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে অক্টোবরের শেষের দিকে এই অভিবাসন নীতি কার্যকর হবে । এটি অনেকের পক্ষে অপ্রত্যাশিত ও ব্যাপক বিভ্রান্তিকর।
নতুন নীতিমালার অধীনে যা পরিবর্তন হচ্ছে–
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পিতা বা মাতা-পিতার কাছে দেশের বাইরে জন্ম নেওয়া শিশুরা অভিবাসী ও জাতীয়তা আইনের মাধ্যমে জন্মের সময় আমেরিকার নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে, যতক্ষণ না বাবা-মা নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে।
১৮ বৎসর বয়সের আগে বিদেশে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জন্মের পরে নাগরিকত্ব অর্জনের অন্যান্য উপায়ও রয়েছে । উদাহরণস্বরূপ, বিদেশে জন্ম নেওয়া শিশুরা যারা গ্রিন কার্ড ধারণ করে তারা পিতা-মাতার মার্কিন নাগরিকত্বের সূত্রে নাগরিকত্ব পাবে।
ইউএসসিআইএস এক কর্মকর্তার মতে , দেশের বাইরে জন্ম জন্মগ্রহণ করা শিশুরা প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জন করে যা এই নীতি পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হবে। পূর্ববর্তী ইউএসসিআইএস নীতিতে বলা হয়েছিল যে নাগরিকত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে বিদেশে জন্মগ্রহণ ও বসবাসরত এই শিশুদের নাগরিকত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “বাসিন্দা” ধরা হত।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশে জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক পিতা-মাতার কোনও শিশু, যার কোন গ্রিন কার্ড নাই , নতুন নীতিমালার অধীনে সেই শিশুটিকে আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। এই পরিবর্তনটি নাগরিক, যুক্তরাষ্ট্রের পরিষেবা সদস্য বা সরকারী কর্মচারীদের শিশুদের উপরও প্রভাব ফেলবে।
বিদেশে জন্মগ্রহণ করে এসব শিশুরা মার্কিন নাগরিক হতে পারবে কিনা এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় দেখা গিয়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এক্ষেত্রে শিশুটি গ্রীন কার্ড হোল্ডার হতে পারবে , যার দরুন সে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে এবং তার বাবা-মার সাথে সেখানে থাকতে পারে। এটি মার্কিন নাগরিকত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “রেসিডেন্স ” হিসাবে গণ্য হবে। অন্যদিকে , মার্কিন নাগরিক পিতা বা মাতা-পিতা অভিবাসী আইনের ভিন্ন ধারার অধীনে যদি তাদের সন্তানের পক্ষে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তবে শিশু বিদেশে থাকা সত্ত্বেও নাগরিক হতে পারবে।
গ্রিনকার্ড পাবেন না দরিদ্ররা–
সাম্প্রতিককালে ট্রাম্প প্রশাসনের আরেক কঠোর নীতি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এই নীতির আওতায় স্বল্প আয়ের মানুষেরা যারা দরিদ্র ও সরকারি সহায়তা উপর নির্ভরশীল তারা গ্রীন কার্ড পাবেন না। ‘পাবলিক চার্জ রুল’ শীর্ষক নতুন এ নীতিমালা কার্যকর হবে আগামী ১৫ অক্টোবর। খতিয়ে দেখা হবে প্রায় চার লাখ বৈধ অভিবাসীর আবেদন।যারা অসচ্ছল ও ভবিষ্যতে মেডিকেইড, ফুড স্ট্যাম্পসহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের প্রয়োজন হবে, তাদের গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে গরিব বৈধ অভিবাসীদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানো কিংবা গ্রিন কার্ড পাওয়া কঠিন করা হচ্ছে।পাশাপাশি ন্যূনতম আয়ের শর্ত পূরণ করতে না পারলে নাগরিকত্বের পাশাপাশি হারাবেন ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগও।
এই নীতি অনুযায়ী চার সদস্যের এক পরিবারের আয় যদি ৬৪০০০ ডলার হয় তাদের গ্রীন কার্ড পেতে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু যাদের আয় এর থেকে কম তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে ভবিষ্যতে তারা সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করবে না।
এই নীতির ফলে হাজার হাজার গ্রীন কার্ড প্রত্যাশী ব্যক্তিদের মাথায় হাত পড়েছে। যারা এতদিন আমেরিকায় নাগরিকত্বের স্বপ্ন দেখে এসেছেন তাদের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে এই নিয়ম অনুযায়ী আগেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা এবং শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা এ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ ও অবৈধ অভিবাসীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে কঠোর পরিকল্পনা হচ্ছে এটি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন , ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করবে, বিভাজিত করবে এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুন্ন হবে। এমনকি অভিবাসীদের প্রতি কঠোর মনোভাবের জন্য অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে।এই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে লাখো প্রবাসী , মামলা হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে। ডেমোক্র্যাটরা বরাবরের মতই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এখন দেখার বিষয় ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন বিরোধী কঠোর নীতি কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়।