বছর বিশেক ধরে চলাফেরা করতে পারেন না নোয়াখালীর সদর উপজেলার শ্রীপুরের আবু তাহের। ব্রেইনস্ট্রোক থেকে অবশ হয়ে গেছে একটি পা। লাঠি ভর দিয়ে কোনো রকম দাঁড়াতে পারেন। এক কথায় কাজকর্ম করতে পুরোটাই অক্ষম। আবু তাহেরের স্ত্রী কমলা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে ৮ জনের সংসারের ঘানি টেনেছেন।
চার মেয়ের মধ্যে তিনজনকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলের বড়জন বিয়ে করে আলাদা। এখন ছোট ছেলে আর সন্তানদের সবার ছোট তানজিনা আক্তার তানিসাকে নিয়ে কোনোভাবে পার করছেন অভাবের দিনগুলো। দুই সন্তান নিয়ে পুরোনো একটা টিনের ঘরে বাস করেন তাহের-কমলা দম্পতি।
তানিসার জন্মের আগেই পঙ্গু হয়ে ঘরে পরেছেন তার বাবা। বাবাকে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়াতে দেখে দেখে বড় হয়েছেন তানিসা। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সে উপার্জন থেকে সংসার চালানো এবং তার লেখাপড়ার খরচ কিভাবে চালাচ্ছেন মা, সেটা দেখে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।
অভাবী সংসারের সেই কিশোরীর চোখেমুখে এখন স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। তার এই স্বপ্নের ফুল ফুটিয়েছে ৩৫ তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস। কিশোরীদের ১৫০০ মিটার দৌড়ে ৫:১৭,৭৯ মিনিট সময় নিয়ে জিতেছেন স্বর্ণ। এই ইভেন্টে নোয়াখালীর কোনো অ্যাথলেটের এটাই জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণ জয়।
রফিক উল্যাহ আক্তার মিলন দেশের তৃণমূল পর্যায়ের অ্যাথলেটিক কোচ। নাজমুন্নাহার বিউটি, সামসুন্নাহার চুমকি, সুমিতা রানী, সামসুদ্দিন ও মাহফুজুর রহমান মিঠুসহ অনেক অ্যাথলেট তৈরি এই মিলনের হাতে। আর নোয়াখালীর হয়ে ১৫০০ মিটার দৌড়ে প্রথম স্বর্ণ জেতা তানিসাকে আবিষ্কার করেছেন তার স্ত্রী শাহিন আক্তার। যিনি নোয়াখালী আহমদিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল টিচার। ওই বিদ্যালয়েই ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী তানজিনা আক্তার তানিসা।
স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ভালো দৌঁড়ায়। দুইবার দ্বিতীয় হয়েছেন। তা দেখেই তাকে অ্যাথলেটিক কোচ স্বামী রফিক উল্যাহ আক্তার মিলনের হাতে তুলে দেন শাহিন আক্তার। মিলন সাহস বাড়াতে গত সামার অ্যাথলেটিকসে সিনিয়রদের সঙ্গে ৩০০০ মিটার দৌড়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন তানিসাকে।
জুনিয়র মিটে ৩০০০ মিটার ইভেন্ট নেই। তানিসা খেলেছেন ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌঁড়ে। এর মধ্যে ১৫০০ মিটারে জিতেছেন স্বর্ণ। দারুণ এই কৃতিত্বের পর ১৩ বছর বয়সী এই কিশোরী শোনালেন তার অভাবী জীবনের কাহিনী। কিভাবে তার মা পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান এবং তার লেখাপড়ার খরচ দেন।
‘আমার বাবা অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারেন না। মা অন্যের বাড়িতে থালা-বাসন ধোয়াসহ নানা কাজ করে টাকা রোজগার করেন। সেই টাকা দিয়ে সংসার চালান। আমার লেখাপড়ার খরচও দেন। আমার বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। তিনি সিএনজি অটো রিক্সা চালান। তিনি সপ্তাহে কিছু টাকা দেন। মায়ের উপার্জন আর ভাইয়ের দেয়া টাকায় আমাদের চলে না। টানাটানির সংসার’-বলছিলেন তানিসা।
জুনিয়রে অভিষেক হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছেন তানিসা। গত সামার অ্যাথলেটিকসে ৩০০০ মিটারে দৌড়িয়েছেন সিনিয়রদের সঙ্গে। সেটা ছিল শুধুই অংশ নেয়া। এবার জুনিয়রে দৌড়িয়েছিলেন পদকের লক্ষ্যে। প্রথম আসরেই ধরা দিয়েছে স্বর্ণ।
‘আগেরবার আসলে এমনিই দৌড়িয়েছিলাম। তাই কোনো ভয় ছিল না। এবার কিন্তু শুরুতে আমি ভয় পেয়েছিলাম, পারবো তো? আবার বিশ্বাসও ছিল। ভয়েভয়ে দৌড়িয়েই সবাইকে পেছনে ফেলেছি। এখন আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। আগামীতেও পারবো’-বলছিলেন তানজিলা।
কেবল অ্যাথলেটিকসই নয়, তানজিলা খেলেন ফুটবল, ভলিবল ও হ্যান্ডবলও। কিন্তু এখন অন্যগুলো বাদ দিয়ে শুধু অ্যাথলেটিকস নিয়েই ক্যারিয়ার গড়তে চান নোয়াখালীর এই কিশোরী। লক্ষ্য জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও স্বর্ণ জেতা। তারপর দেশের হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পদক জেতা। ট্র্যাকে দৌড়িয়েই তানিসা হাসি ফোটাতে চান তার দুঃখী মা-বাবার মুখে।