বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার ছোট একটি গ্রাম মানিকপুর। এ গ্রামেই বাস করেন ১৭ বছর বয়সী ময়না। স্বামী কৃষি কাজ করেন। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয় কিশোরী ময়নার। গত দুইবছর আগে একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। আবারও সন্তান সম্ভবা। পরিবারের সবার ইচ্ছা এবার একটি কন্যা সন্তান হবে ময়নার। কিন্তু দুঃখের বিষয় ময়নার আবারো পুত্র সন্তান হলো। বাড়ির সবারই মন খারাপ। ময়নার প্রতি দেখা গেল অযতœ আর অবহেলা। যতই দিন যাচ্ছে ময়নার প্রতি সকলের অবহেলার মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। অপুষ্টি আর অযত্নে ময়নার শারিরীক অবস্থা দিন-দিন খারাপ হতে লাগলো। এক সময় ময়নার প্রসব পরবর্তী জটিলতা দেখা দেয়। ময়নার স্বামী আলী আকবর একটি হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। কিন্তু অবহেলা আর অনাদরে আস্তে-আস্তে নিঃশেষ হয়ে যায় ময়না। মা হারা হয়ে পড়ে অবুঝ দু’টি শিশু।
বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজে আইনতঃ নিষিদ্ধ হলেও এখনো পর্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ের বছর পার হতে না হতেই তারা গর্ভবতীও হয়ে পড়ছে। তারপর সে যখন মা হতে যায় তখন তার সংকট দেখা দেয় চারদিক থেকে। গ্রামাঞ্চলে অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বর্তমানে অনেক বেশী। কারন তাদের অনেকেই দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় এ সকল মানুষদের। সচেতনতার অভাবে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে পদে-পদে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী ’নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালন শুরু হয়েছে।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করে প্রসুতিকে সুস্থ রাখতে পারলে নবজাতকেরা সুস্থ থাকবে এবং গড়ে উঠবে একটি সুস্থ জাতি।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছিল। আর বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশে ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসুতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ব্যাপক কাজ করছে। বর্তমানে ২০১৯ সালে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭২ জন।
গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠির মায়েরা যাতে হাতের কাছে মাতৃ স্বাস্থ্য সুবিধা পান সে লক্ষ্যে প্রতি ৬ হাজার জনগোষ্ঠির জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে উদ্দ্যোগ নেয়া হয়েছে। শহরের বস্তি এলাকা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চড়, হাওড়-বাওড় ও পার্ব্বত্য এলাকায় নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ ও সেবা কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী ’নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালন শুরু হয়েছে।
নারীর মাতৃত্বকে নিরাপদ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে বাল্যবিবাহ রোধ। প্রতিটি পিতামাতার উচিৎ তার মেয়ে সন্তানকে ১৮ বছর পুর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেয়া। কারণ এর আগে মেয়েদের জননতন্ত্র পুর্ণতা পায় না। নারী হিসেবে সংসার পরিচালনার মানসিকতা গড়ে ওঠে না। এছাড়া প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কেও থাকে অজ্ঞ।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে এখনো চিকিৎসকদের বিপরীতে অভিজ্ঞ নার্সের সংখ্যা অনেক কম। প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যাও কম। কিন্তু মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমাতে তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। একজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নার্স-ধাত্রী তৈরীতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রসবকালীন যতœ ছাড়াও প্রসব পরবর্তী জরুরি কিছু যতœ আছে যা প্রসুতি মা ও সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন। যেমন : মাকে সর্বদা পরিস্কার রাখা, মায়ের জন্য পর্যাপ্ত সুষম খাবার, বিশ্রাম ও যতেœর ব্যবস্থা করা। শিশুর নাভীর যতœ, শিশুর টিকা ও শিশুর খাবার হিসেবে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ইসলামে প্রসুতি ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জন্য জোরালো তাগিদ দেয়া হয়েছে। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষার অভাব ও ধর্মীয় গোড়মির কারনে গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা প্রতিবছর সন্তান ধারণ করে থাকেন। এ কারনে শিশুর সঠিক পরিচর্যা না হওয়ায় পুষ্টিহীন ও রোগাক্রান্ত মা ও শিশুর সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। অথচ মাতৃত্বকালীন অপুষ্টির কারনে রোগাক্রান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যহানি ঘটার ফলে অনেক সময়ই মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়।
পরিবারে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মাকে পুর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। তাকে ভারী ও কঠিন কাজ না দিয়ে তার কষ্ঠ লাঘব করা যায়। ঘন-ঘন সন্তান প্রসব থেকে বিরত রাখার জন্য মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এগিয়ে এসে জনগণকে সচেতন করতে সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। যেসব মা স্বাস্থ্য সেবা পান না তাদের কাছে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে। প্রসুতির প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনা সেবা আরও বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃস্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন অপরিহার্য। তাই প্রসুতির নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।