ভারতে করোনাভাইরাস: অক্সিজেনের সঙ্কট মেটাতে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ পরামর্শ দেয়া হচ্ছে


বাংলা সংবাদ ডেস্ক:সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিতি প্রতিদিনের তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে ভারত করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। অক্সিজেনের জন্য চলছে হাহাকার। অসহায় আর নিরুপায় মানুষ এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে যা রীতিমতো বিপদজনক।

দেশটির অনেকেই অনলাইনে ছড়ানো বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্যে চরম ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়ার পথে পা বাড়াচ্ছেন। যেমন, অনলাইনে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে ঘরে তৈরি ওষুধ দিয়ে কীভাবে অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা বাড়ানো যায়।

নেবুলাইজার অক্সিজেনের যোগান দেয় না
ভারত জুড়ে অক্সিজেনের খোঁজে করোনা রোগীর স্বজনদের হাহাকার আর দৌড়াদৌড়ি দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে একটা ভিডিও ব্যাপকভাবে শেয়ার হচ্ছে, যেখানে একজন ডাক্তার দাবি করছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া না গেলে নেবুলাইজার নামে ছোট একটি যন্ত্র ব্যবহার করুন। নেবুলাইজার চিকিৎসার একটি সরঞ্জাম যেটা দিয়ে রোগীর শরীরে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় সূক্ষ্ম কণার আকারে অনেকটা বাষ্প আকারে।

ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ওই চিকিৎসক দেখাচ্ছেন কীভাবে এই যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। তাকে হিন্দি ভাষায় ব্যাখ্যা করতে শোনা যাচ্ছে যে ‘আমাদের বায়ুমণ্ডলে যথেষ্ট অক্সিজেন আছে যা এই যন্ত্র (নেবুলাইজার) যোগাতে সক্ষম।’

এই ডাক্তার আরো বলেন, ‘আপনার দরকার খালি একটা নেবুলাইজার। এই যন্ত্রটা পেলে এটার মধ্যে দিয়েই আপনি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন টানতে পারবেন।’

সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে যে হাসপাতালের নাম করা হয়েছে সেটি দিল্লির কাছেই। তবে ভিডিওতে যে দাবি করা হয়েছে হাসপাতাল তার সাথে তাদের যোগাযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলেছেন, এভাবে নেবুলাইজারের ব্যবহারের সমর্থনে কোনো ‘তথ্যপ্রমাণ বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা’ নেই।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন নেবুলাইজার যে প্রক্রিয়ায় কাজ করে সেটা অতিরিক্ত অক্সিজেনের যোগান দিতে পুরোপুরি অকার্যকর।

যে ডাক্তার তার ভিডিওতে এই দাবি করেছেন, তিনি সমালোচনার জবাব দিয়ে আরেকটি ভিডিও ছেড়েছেন যাতে তিনি বলেছেন তার বার্তাটি লোকে ‘ভুল বুঝেছে’।

তিনি বলেন, তিনি এটা বলতে চাননি যে নেবুলাইজার অক্সিজেন সিলিন্ডারের বিকল্প হতে পারে। কিন্তু তারপরেও তার মূল ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে গেছে। এখনো অনলাইনে এই ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তার এক সাম্প্রতিক ভাষণে এই ভিডিওর স্ক্রিনশট ব্যবহার করেছেন।

মোদি তার ভাষণে এই ছবিটি দেখিয়ে বলেন, ‘বহু চিকিৎসক সামাজিক মাধ্যমে নানা তথ্য শেয়ার করছেন, তারা ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ-এ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন’ তবে তার ভাষণে তিনি ভিডিওর কথাগুলো বাজিয়ে শোনাননি। শুধু ওই চিকিৎসকের ছবিটি দেখিয়েছেন।

ভেষজ ওষুধও রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায় না
ভারতে সামাজিক মাধ্যম অসংখ্য বার্তায় ছেয়ে গেছে যেখানে ঘরে তৈরি নানাধরনের ভেষজ উপশম ও ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে করোনা ভাইরাস রোগের উপসর্গ চিকিৎসার জন্য যার মধ্যে রয়েছে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেলে কী করতে হবে।

একটা পরামর্শ ভাইরাল হয়েছে যেখানে বলা হচ্ছে কর্পূর, লবঙ্গ, জোয়ান ও ইউক্যালিপটাসের তেলের মিশ্রণ করোনা রোগীর জন্য অক্সিজেন গ্রহণের সক্ষমতা ধরে রাখতে উপকার করে।

করোনাভাইরাস আক্রান্তদের এই ধরনের মিশ্রণ সাহায্য করেছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধের এক চিকিৎসককে দেখা যায় একটি ভিডিওতে এই মিশ্রণকে করোনার চিকিৎসায় ভালো ওষুধ হিসেবে তিনি তুলে ধরছেন। তার এই ভিডিও ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে ২৩ হাজার বার শেয়ার হয়েছে।

কর্পূরের তেল সচরাচর চামড়ায় লাগানোর ক্রিম ও মলমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু এটা সেবন করলে তার সম্ভাব্য ফল খুবই গুরুতর হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রর রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) সতর্ক করে দিয়েছে যে কর্পূরের বাষ্প (ভেপার) নিঃশ্বাসের সাথে টানলে তা বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।

লেবুও কোনো রোগ উপশমের পথ নয়
ভারতের একজন শীর্ষ রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রতি দাবি করেন যে নাকের ভেতর দুই ফোঁটা লেবুর রস দিলে তা অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা বাড়াতে পারে।

এই রাজনীতিক ভিজয় সানকেশ্বর বলেন, যিনি করোনায় আক্রান্ত তার যেসব সহকর্মীর অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। তাদের তিনি এই পরামর্শ দেন ও ‘আধ ঘণ্টার মধ্যে তাদের অক্সিজেনের মাত্রা ৮৮ ভাগ থেকে বেড়ে ৯৬ ভাগে উঠে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ভারতে অক্সিজেন ঘাটতিরে সমস্যা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সমাধান করা যাবে।

এই চিকিৎসা পদ্ধতিও অক্সিজেনের মাত্রার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।

যা ম্যাজিক-চিকিৎসা অবশ্যই নয়
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগব্যায়াম বা ইয়োগ গুরু বাবা রামদেব, সংবাদ চ্যানেলে এসে ও তার ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতে ঘরে বসেই অক্সিজেন মাত্রা বাড়ানোর পদ্ধতি শেখাচ্ছেন।

ভিডিওতে তিনি বলছেন, ‘দেশ জুড়ে চলছে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার কিন্তু আমি আপনাদের একটা ম্যাজিক দেখাবো’ একথা বলে তিনি তার একটা আঙুলে পরে নিচ্ছেন রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র।

তার ইউটিউব চ্যানেলে ওই ভিডিও তিন লাখ বার দেখা হয়েছে। এই ভিডিওতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের এই ব্যায়াম করতে হবে। বসে তিনি তার নিঃশ্বাস কীভাবে ধরে রাখছেন ও কীভাবে এর ফলে তার রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নিরাপদ মাত্রার নিচে চলে যাচ্ছে।

এরপর তিনি বলছেন, ‘দেখুন এই অক্সিজেনের মাত্রা কমতে ২০ সেকেন্ড সময় লেগেছে। এবার দুই বার গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিন, দেখবেন অক্সিজেন (আপনার রক্তে) আবার বাড়ছে। আসলে বাইরেই (বায়ুমণ্ডলেই) যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে।’

ইয়োগা বা যোগব্যায়াম শরীরের জন্য সাধারণভাবে উপকার হলেও করোনার মতো রোগের কারণে অক্সিজেন নেবার ক্ষমতা কমে গিয়ে স্যাচুরেশন মাত্রা যখন পড়ে যায় তখন বাড়তি মেডিক্যাল অক্সিজেন দেবার সুপারিশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ড. জ্যানেট ডিয়াজ বলেন, ‘অক্সিজেনের মাত্রা কমলে সেটা অনেক সময় ধরে কম থাকলে সেটার চিকিৎসা করা না হলে শরীরের কোষগুলো ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে পারে মেডিক্যাল অক্সিজেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *